বন্ধুত্ব মানে শক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান • নতুন ফেনীনতুন ফেনী বন্ধুত্ব মানে শক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বন্ধুত্ব মানে শক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান

রাশেদুল হাসানরাশেদুল হাসান
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৫:৫৪ অপরাহ্ণ, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বন্ধুত্বকে আমি যেমন করে আবিষ্কার করি, তার ক্ষমতায়, শক্তিতে, মন্ত্রে আমি যেমন করে বিস্মিত হই, উপকৃত হই, জগতের সঙ্গে যুক্ত হই, সেই জায়গাটা থেকেই কথা শুরু হোক। বন্ধুত্বকে আমি দেখি পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, শুভ্র ও শুভ, তার ভিত হিসেবে, যার ওপরে যেকোনো সম্পর্কের ইমারত মজবুত হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, রড-সিমেন্ট ইত্যাদি জরুরি উপাদানের মিশেলটা যদি সঠিক অনুপাতে না থাকে, তাহলে ইমারত নড়বড়ে হবে, ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। বন্ধুত্বের ভেতরেও সে রকম কিছু উপাদান আছে, যেগুলো না থাকলে সেটাকে বন্ধুত্ব বলা যায় না।

বন্ধুত্ব মানে শ্রদ্ধা, সম্মান, সমতা, স্বচ্ছতা ও ভালোবাসার টান। বন্ধুত্ব মানে তুমি যেমনই হও, আমি ব্যবহারে শ্রদ্ধাশীল হব, তোমার সম্মান রক্ষায় সচেতন হব, তোমাকে আমার কম বা বেশি নয় সমান মর্যাদা দেব, সব অনুভূতির প্রকাশে স্বচ্ছতা বজায় চলব, ভালোবাসায় যত্নশীল হব।

বন্ধু বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝে থাকি, এমন কোনো এক বা একাধিক চরিত্র যে আমাদের পারিবারিক কাঠামোর বাইরে অবস্থান করে, দীর্ঘদিনের পুরোনো মানুষ, যার সঙ্গে হয়তো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য কোথাও অন্য কোনো উপলক্ষে একসঙ্গে মেলামেশার ইতিহাস রয়েছে, আত্মার বন্ধন রয়েছে এবং রক্তের বন্ধন নেই। অর্থাৎ বন্ধু একজন আলাদা মানুষ, পরিবারের বাবা-মা-ভাই-বোন রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়তার বাইরে যার অবস্থান, অথচ আত্মার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার ঘনিষ্ঠতার সুবাদে যাকে পরিবারের ভেতরের কারও মতোই, বা তার চেয়েও আপন বলে বোধ হয়।

লক্ষণীয়, আমরা অজ্ঞাত কারণেই সূত্র করে নিয়ে রক্তের বন্ধনকে এগিয়ে রেখে আত্মার বন্ধনকে পিছিয়ে দিয়েছি। আসলে এই বিভাজন নিষ্প্রয়োজন। বরং বলতে চাই, জগতে কারও কারও সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক বা আত্মীয়তা আছে, কারও কারও সঙ্গে নেই। কিন্তু আত্মার বন্ধনই সম্পর্কের ভিত রচনা করে, আত্মার টানটাই আসল সম্পর্ক, রক্তের বা আরও নানা রকম আয়োজনের যে বন্ধন, সেটা সম্পর্কের একটা বাহ্যিক ডাইমেনশন বা মাত্রা মাত্র। আত্মার বন্ধনটাই সম্পর্ক, আর আত্মার বন্ধনটাই বন্ধুত্ব। বলতে চাই, রক্তের আত্মীয়তা না থাকলেও দারুণ সুন্দর মজবুত সুসম্পর্ক হতে পারে আত্মার টান অর্থাৎ বন্ধুত্বের গুণে। কিন্তু বন্ধুত্বের যে আত্মীয়তা যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপরিহার্য বলে দাবি করছি, তা অনুপস্থিত থাকলে রক্তের বা কাগজে গড়া চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক যতই ফলাও করে থাকুক না কেন, তা পানসে লাগতে পারে। আমাদের জীবনে, আমাদের চারপাশে আমরা এমন অনেক বন্ধুত্বহীন, পারস্পরিক সম্মানহীন, প্রাণহীন, প্রেমহীন সম্পর্ক অহরহ দেখতে পাই।

যে বাবা-পুত্রের মধ্যে শুধু ভয়ভীতি আর দায়িত্ব পালনের আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও দারুণ বন্ধুত্ব আছে, তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পিতা-পুত্র, মা-সন্তান। ভাই-বোনের ক্ষেত্রেও একই কথা। যে স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক যুগল একে অন্যের ভেতরে শুধু সুরক্ষা নয়, বন্ধুত্বের সমতাকে সব অর্থে প্রাধান্য দেয়, প্রতিষ্ঠা দেয়, তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক-প্রেমিকা, জীবনসঙ্গী। বন্ধুত্বের শক্তি এবং মন্ত্র এতই ব্যাপক যে এর প্রভাবকে শুধু পরিবারের গণ্ডির ভেতরেই আবদ্ধ করে রাখলে আমরাই বঞ্চিত হব। বন্ধুত্ব মানে ভীতির অনুপস্থিতি, যা দেয়াল ভাঙে এবং দায়িত্বশীলতা বাড়ায়। আমাদের কাজের পরিবেশের ক্ষেত্রেও বন্ধুত্বের খোলামেলা হাওয়া থাকলে, কপট গাম্ভীর্যের ভারী পরিবেশ না থাকলে সেখানেও একটা পরিবার তৈরি হয়। যে রাষ্ট্র বন্ধুভাবাপন্ন, তার নাগরিকেরাও অধিক দায়িত্বশীল হবে। আমাদের বাড়িতে যে মানুষ জীবনের প্রয়োজনে খেটে কাজ করে, সে তার কাজটাই হয়তো করে যাবে জীবনভর, কিন্তু আমার মুখের একটা সহজ বন্ধুসুলভ হাসির উষ্ণতা তার জীবনের কাঠিন্যের গ্লানি অনেকটাই দূর করবে, এটাই বন্ধুত্বের শক্তি, ভালোবাসার শক্তি, আর এটুকু করার ক্ষমতা মানুষ হিসেবে এখনো আমাদের হাতেই আছে।

এই বোধ যখন একটা সমাজের অধিকাংশ মানুষের ভেতর সহজাতভাবে বিরাজ করে, সেই সমাজে বন্ধুত্বের পথ ধরে শান্তি আসে। একজন অন্য ধর্মের বা পরিচয়ের মানুষকে আমি যখন বন্ধু ভাবতে পারি না, তাকে তার মতো করে মেনে নিয়ে আমার প্রাণের ভেতরে টেনে নিতে পারি না, শুধু তাকে ছোট করে আর আমাকে বড় করে ‘আমার আমার-তোমার তোমার’ বিভাজন করি, তখনই সেই সমাজে আমি বন্ধুত্ব নয়, শত্রুতার বিষ ছড়ানোর প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে ব্যক্তি হিসেবে অংশ নিয়ে ফেলি। আমাদের চেতনার সব রন্ধ্রে বন্ধুভাবাপন্নতার সুর, স্থান-কাল-পাত্রনির্বিশেষে বেজে চলার নামই ‘মানবতা’। মানবতার প্রথম শর্তই বন্ধুভাবাপন্নতা। আজকের পৃথিবীতে যে সহিংসতার চিত্র, তার থেকে উত্তরণের দিকে যদি সভ্যতা হিসেবে আমরা এগোতে চাই, তাহলে যে যেখানে যেই ভূমিকায় বা যেই সম্পর্কেই থাকি না কেন, সেখান থেকে সারাক্ষণ এই বন্ধুত্বের সংগীতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়াটাই আমাদের একমাত্র পথ। বিশ্বের শান্তিপ্রক্রিয়ায় এটুকু করার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। কেননা আমরা সবাই যুক্ত এবং এক অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্বের অংশ।
সম্পাদনা:আর এইচ/এইচ আর

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.