‘অসীম প্রেমের ঘোর থেকে জন্ম হয় কবিতার’ • নতুন ফেনীনতুন ফেনী ‘অসীম প্রেমের ঘোর থেকে জন্ম হয় কবিতার’ • নতুন ফেনী
 ফেনী |
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

‘অসীম প্রেমের ঘোর থেকে জন্ম হয় কবিতার’

রাশেদুল হাসানরাশেদুল হাসান
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৪:০৮ অপরাহ্ণ, ২২ জুলাই ২০১৫

বাংলা সাহিত্যের কবিতার আকাশে নব্বই দশকে যে কয়েকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র রয়েছে তাদের মধ্যে একজন প্রেম-প্রকৃতি সৌন্দর্যের কবি জাকির আবু জাফর। কবিতার সাথে ঘর সংসার করছেন নিবিড় মনোযোগে। তার চেতনায় মনের অনুভব প্রকৃত বিশ্বাসকে  শব্দে শব্দে গেঁথে কবিতায় নির্মাণ করেন কালের সাঁকো। সময়ের বিবর্তনে এ সাঁকো বেড়ে কবিতার জগত ছাড়াও বিচরণ করছেনÑছড়া, কথাসাহিত্য, গানের জগতে। অনবরত বাজিয়ে চলছেনÑ সম্ভাবনার তূর্য নিনাদ। এ যাবত কালে বই বেরিয়েছেÑ নির্বাচিত কবিতাসহ ৩১টি। প্রায় প্রতিটিই গ্রন্থই পাঠকনন্দিত। সদালাপী-আত্মবিশ্বাসী কবি জাকির আবু জাফরের জন্ম ফেনীর সোনাগাজীতে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনে করলেও কবিতাকে নিয়ে স্বপ্ন আকাশ চূড়া। এ স্বপ্ন বৃক্ষের বিস্তৃত ডালপালা দিন দিন সবুজ থেকে সবুজ হয়ে উঠছে। তাই স্বপ্নের ফেরিওয়ালার সাথে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়-আঙ্গিক ও রহস্য উন্মোচনে নতুন ফেনী’র পক্ষে মুখোমুখি ইমরান মাহফুজ

নতুন ফেনী : কবিতাকে কোন বয়স থেকে চিনতে শুরু করলেন?
জাকির আবু জাফর: যে বয়সে মানুষের বুকের ভেতর থাকে স্বপ্ন ও কল্পনার পৃথিবী। যে বয়স কেবলই হারিয়ে যাওয়ার কেবলই উড়ে যাবার। সেই কৈশোরকালে যা আমাকে আজো স্মৃতির ঘূর্ণিতে নিক্ষেপ করে। যে ঘূর্ণি আমাকে জীবনভর তাড়িয়ে চলছে। কবিতার সাথে সেই থেকে আমার সখ্য। সেই থেকে কবিতা আমার আত্মার ঘনিষ্ঠতায় জেগে আছে। সম্ভবত: জেগে থাকবে চিরকাল। কেননা কবিতাকে এক মুহূর্তে অথবা একটি অধ্যায়ে চেনা যায় না। ফলে তাকে চেনার প্রয়াসেই ঝরে যাচ্ছে আমার সকালগুলো। আমার সমস্ত দুপুর। আমার সকল সন্ধ্যা এবং আমার তাবৎ রাত্রির অনন্তকাল।

নতুন ফেনী : কবিতাকে চিনতে শুরুর বয়সে কবিতার সংজ্ঞা কি জানতেন?
জাকির আবু জাফর: এক সময় মনে হতো কবিতা কোন মানুষ লেখে না। এটা কোন স্বাভাবিক ঘটনা বলেও মনে হতো না। কবিতা যখন চিনেছিÑ তখন মনে হয়েছে আসলেই কবিতা মানুষ লেখে না। মানুষ দ্বারা লিখিত। সুতরাং যখন কবিতাকে চিনতে শুরু করেছি তখন সেই মুহূর্তে কবিতাকে বিষণ রহস্যময় বলে মনে হয়েছে। এটা সত্য সেই রহস্যের ঘোর আজো কাটেনি।

নতুন ফেনী : গোলাপের গল্প কবিতার একটি লাইন- একদা জীবন ছিলো ‘জলডোবা শামুক ঝিনুক অথবা ডুবুরীর পাখির পাখায় ছিটানো জলের মতন’- একদা বলতে কোন সময়টা?
জাকির আবু জাফর: একদা বলতে সমস্ত অতীত যা পৃথিবীর বুকের ওপর বয়ে গেছে চিরকালের দিকে। যা মানব সৃষ্টির আগ থেকে বয়ে যাচ্ছে মহাকালের দিকে। একজন কবি নির্দিষ্ট কালে বসবাস করলেও তার সময় অনির্দিষ্টের অনন্তে বহমান। সুতরাং একজন কবিকে সীমাবদ্ধতার প্রাচীরে বন্দি করা চলে না।

নতুন ফেনী : দু’হাতে অনেক আকাশ কবিতার আরেকটি লাইন হঠাৎ আমার সময় আমাকে ঘুরিয়ে দিলো প্রণয়ের দিকে, ‘আমার সময়’- সম্পর্কে বলুন।
জাকির আবু জাফর: আমার সময়তো চিরকালের বহমান একধারা। চির চলিষ্ণু এক গতি। যার প্রবাহে আমরা সকলেই প্রবাহিত। সকলেই চলমান বহমান এবং ভাসমানও বটে। এই বহমান সময় কখনো কখনো ব্যক্তির একান্ত অনুভূতিকে উন্মোচিত করে। তুলে ধরে আনন্দের পতাকা। আমার সময় সে আনন্দকেই মন্থন করে।

নতুন ফেনী : আপনার ভেতর বাংলা কবিতার আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদ কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে বলে মনে করেন?
জাকির আবু জাফর: আধুনিক শব্দটি আপেক্ষিক। আপেক্ষিক এ কারণে আজ যা আধুনিক কাল তাই অতীত। যেমন রবীন্দ্রনাথ তার কালে আধুনিক ছিলেন। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন তার কালে আধুনিক। একইভাবে কাহ্নপাদের কালে তারা আধুনিক ছিলেন। সুতরাং আমার কালে আমি সামগ্রিক অর্থেই আধুনিকতাকে মান্য করবো এটি কোনো নতুন কথা নয়। তবে আজ বসে যিনি গতকালের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন তার কথা আলোচনায় না তোলায় শ্রেয়। এই প্রেক্ষিতে আমি বলবো আধুনিকতাবাদ বলে কোনো বাদ আমি মানি না। কেননা মানুষকে আধুনিকই থাকতে হয়। আধুনিকতা ধারণ করেই এগুতে হয়। কবিতার ক্ষেত্রে এ সত্য আরো বেশি স্বচ্ছল।

নতুন ফেনী : আপনার কবিতা পাঠে দেখলাম- জীবনানন্দকে খুব পড়েন। লক্ষ্য করেছি-মেঘের মানচিত্র অথবা বনান্তরের দিন, রোদেরও আছে অন্ধকার’ বই-এ এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য-
জাকির আবু জাফর: জীবনানন্দ কেনো সব আনন্দকেই মন্থন করে এগুতে হয় কবিতার পথে। কিন্তু নিজের আনন্দকেই উন্মোচন করা কবির কাজ। এ কাজে আমার সমস্ত চাঞ্চল্য উজ্জীবিত। সুতরাং আমার কবিতা পড়ে যদি জীবনান্দকে মনে পড়ে এতে আমার আনন্দের কোনো কমতি হবার কথা নয়। আবার কবি জীবনান্দকে মনে পড়লে আমার আনন্দ বেড়েই যায়। বাড়ে কারণ আমি তার অনুকারী নই। তারই পথের পথিক। তারই অভিযানের একজন তূর্যবাদক। যার ধ্যানে জ্ঞানে চেতন অবচেতনে জেগে থাকে কবিতার মগ্নতা। জড়িয়ে থাকে কবিতা সুন্দরের উদ্ভাস। এই উদ্ভাসে উদ্বোধিত আমার কবিতার পৃথিবী।

নতুন ফেনী : তিন দশক ধরে কবিতা লিখে চলছেন- কবিতায় কি পান আর কবিতাকে কি দেয়ার চেষ্টা করেন?
জাকির আবু জাফর: কবিতায় পাই জীবন ও জগতের এক আশ্চর্য রহস্যের অনুভূতি। পাই নরনারীর প্রেম ও বিরহের  চিরন্তণ বিস্ময়বোধ। পাই প্রকৃতির গৃঢ়তম সুন্দরের প্রকাশ। দৃশ্যের আড়ালে দৃশ্য এবং তাঁর দ্রষ্টব্যের আনন্দ কবিতাতেই পাই। আর আমি কবিতাকেই জানি শব্দ ও ভাষার সমৃদ্ধি। দেই নির্মোহ প্রেমের সঙ্গ।

নতুন ফেনী : তরুণদের মধ্যে বহুল পঠিত ‘ডলারের গল্প’ কবিতাটির জন্মমুহূর্তের কথা যদি বলেন?
জাকির আবু জাফর: কখনো কখনো মুহূর্তেই জন্ম হয় কবিতার। যে মুহূর্তে কবিতাটির জন্ম হয় সে মুহূর্তের ভাবনাটাইতো থাকে কবিতার শরীরজুড়ে। ‘ডলারের গল্প’ কবিতাটি যে মুহূর্তে জন্ম নিয়েছে সে মুহূর্তের মর্তবাইতো চিত্রিত  কবিতার সারা দেহে।

নতুন ফেনী : অনেকে বলেন- আল মাহমুদের কবিতার সাথে আপনার জগত কোথাও কোথাও পরম্পর-এ সম্পর্কে-
জাকির আবু জাফর: আল মাহমুদের কবিতার সাথে আমার কবিতার জগত কোথাও কোথাও যদি পরম্পর হয় এতো আমার জন্য আনন্দের খবর! কেননা একটু আগেই তো এক প্রশ্নে দেখা গেলো আমার কবিতা পাঠে জীবনানন্দকে স্মরণ করা যায়। এখন আল মাহমুদকে। বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ দু’জন কবিকে যদি আমার কবিতা পাঠে স্মরণযোগ্য মনে হয় আমিতো নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান বলে মনে করবো।

নতুন ফেনী : বাংলা সাহিত্যে কাদের আপনি গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে মনে করেন, যাদের লেখায় আপনিও মুগ্ধ-
জাকির আবু জাফর: বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ নামের তালিকাতো খুব ছোট নয়। যাদের নাম কালের অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে যারা মরেও বেঁচে আছেন তারাতো সবাই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। আমি মাইকেলকে স্মরণ করি। ভুলি না শাহ্ মোহাম্মদ সগীরকে। রবীন্দ্রনাথ আমাকে পড়তেই হয়। নজরুলের সান্নিধ্য ছাড়া আমার চলে না। জীবনানন্দ আমাকে অভিভূত করে। জসীম উদ্দীনের মাটির ঘ্রাণ আমার বুকে তুলে দেয় সমগ্র বাংলাদেশ। ফররুখ আহমদের স্বপ্নচারিতায় আপ্লুত। সৈয়দ আলী আহসানের ছায়ার  আরাম আমাকে নিতেই হয়। শামসুর রাহমান আমি পাঠ করি। আল মাহমুদ আমাকে জাগায় বিস্ময়ের ঘোর। ফজল শাহাবুদ্দীনের বিশ্ববিক্ষণ আমাকে আলোড়িত করে।

965829_229158337261522_968706971_o

নতুন ফেনী : আপনার দৃষ্টিতে ’৯০ দশকে সাহিত্যের কোন দিকে খুব বেশি কাজ হয়েছে বলে মনে করেন?
জাকির আবু জাফর: নব্বই দশকে এক ঝাঁক তারুণ্যদীপ্ত কবির আবির্ভাব ঘটেছে। যারা নানানভাবে আলোচিত সমালোচিত এবং একই সাথে প্রশংসিতও। পঞ্চাশের কবিরা বাংলা আধুনিক কবিতায় নতুন জগৎ নির্মাণ করেছেন। ষাটে তা গড়িয়ে গেছে এক ধরনের  উন্মাদনার ভেতর। সত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের ডামাডোল কবিতাকে করে তুলেছে খানিকটা শ্লোগানধর্মী। আশিতে কিছুটা থিতু হয়েছে বটে তবে যুদ্ধের আঁচ লেগে আছে কবিতার শরীরে। নব্বই দশকে কবিতা বাঁক নিয়েছে নতুন আঙ্গীকে। তবে কোনো দশকই কোনো দশক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা নয়। আলাদা হতে পারে না। কারণ কবিতা একটি বহমান ধারা। একটি স্রোতবাহী নদী। যা মাঝে মাঝে বাঁক নেবেই। কিন্তু তার জলরাশি, তার ঢেউ এবং পানির স্বাদ কিন্তু খুব পরিবর্তনশীল নয়।
একথা সত্যি প্রতিটা দশকেই কবিতার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়। যে কারণে দশকের একটি গুরুত্ব রয়েছে। নব্বইয়ের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এ দশকের কবিতা আত্মদহনের বেদনা থেকে অবমুক্তি পেয়েছে। খানিকটা মুক্তচিন্তা, আধুনিক জীবনের জটাজাল এবং আন্তবিশ্বের চিন্তার সমন্বয় ঘটেছে। সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদী সভ্যতার দলন পীড়ন এবং  তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের দুরাবস্থার চিত্রও নব্বইয়ের কবিতায় উৎকীর্ণ। প্রকৃতির নিবিড় আনন্দের গূঢ়তা এবং রহস্যময়তার সৌন্দর্য নব্বইয়ের কবিতাকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা।

নতুন ফেনী : সমকালে তরুণদের কবিতা ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি কিছু বলেন-
জাকির আবু জাফর: সমকালে তরুণেরা দারুণ লিখছে। তারুণ্য মানেই ভেঙে চুরে পথ আবিষ্কার করার অভিযাত্রা। আমাদের তারুণ্য তাই করছে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তবে এটা সত্য নতুন কিছু নির্মাণের অগ্রপথিকের সংখ্যা অবশ্যই কমই থাকে। তরুণেরা পথ চলতে চলতে খুঁজে নেয় আপন পথ। তবে এরজন্য ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা দরকার। দরকার ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্তি। যারা জানে  কাল কোনো বিচ্ছিন্নতা গ্রাহ্য করে না। তারা অতীতকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য প্রকাশে নিবৃত্ত থাকে। বরং অতীতকে ধারণ করেই ভবিষ্যতের নতুন পথ নির্মাণে কাজ করে যায়। তারুণ্যের এ দায়িত্বশীলতার অভাব থাকলেও আমাদের তারুণ্য এ বিষয়ে উদাসিন নয়।

নতুন ফেনী : কবি ও কবিতার জন্য দলপ্রীতি কিংবা গোষ্ঠীপ্রীতি কতটা সহায়ক?
জাকির আবু জাফর: কবি এবং কবিতার জন্য দলপ্রীতি এবং গোষ্ঠীপ্রীতি সহায়কতো নয়-ই বরং ক্ষতিকর। কবিতার জন্য দলবাজী হবে কেনো। কবিতাতো কোনো দল কিংবা গোষ্ঠীর সম্পদ নয়। কবিতা একান্ত কবির বিষয়। কবি যতটা নীরবে নিভৃতে কবিতার কাছে যাবেন যতটা মগ্নতার ভেতর দিয়ে যাবেন ততটাই কবিতা তার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। আত্মমগ্নতার ঐশ্বর্যে কবিতাকে আবিষ্কার করতে হয়। গলাবাজী, দলবাজী, গোষ্ঠীপ্রীতি এবং রাজনৈতিক ঢলাঢলি কবিতার কোনো উপকারে আসে না। কবিতা চিরদিন একান্ততার সান্নিধ্য কামনা করে। একাকীই বসত করে কবিতার সংসার। কবির ভক্ত থাকে দল থাকে না। কেননা একজন কবিতো সকলের। কে তাকে গ্রহণ করলো কে করলো না এই নিয়ে কবির অথবা কবিতার কোনো অনুযোগ  নেই। একজন কবি কবিতার প্রেম ছড়িয়ে দেন সর্বত্র সবার জন্য।

নতুন ফেনী : কবিতা ও প্রেম দুটো বিষয় অমীমাংসিত আপনিও কি তাই মনে করেন?
জাকির আবু জাফর: কবিতা ও প্রেম দুটো বিষয় অমীমাংসিত ঠিক বলবো না- দুটোই রহস্যময়ী। তবে প্রেমের চেয়ে কবিতার রহস্য অধিক কুয়াশাচ্ছন্ন। বেশি রহস্যময়ী। তাছাড়া দু’য়ের ব্যবধানতো রয়েছেই। প্রেমে ছলা থাকে। কবিতায় ছলনা নেই। কবিতায় প্রেম থাকে। প্রেমে কবিতা নাও থাকতে পারে। তবে প্রেম বিনে কবিতার গতিও হয় না। কেননা কবিতাকে প্রেম দিতে হয় সীমাহীন। অসীম প্রেমের ঘোর থেকে জন্ম হয় কবিতার। ফলে প্রেমও কবিতার মতো চিরদিন রহস্যের ঘোরে আড়াল থাকে।  থাকে স্পর্শের বইরে। যাকে অনুভব করা গেলেও হাতের মুঠোয় কখনো ধরা পড়ে না।

নতুন ফেনী : আপনার বাচনভঙ্গি ও মুখয়াভবে নজরুলের উত্তরসূরী বলে থাকেন কেউ কেউ।  কেমন করে নেন বিষয়টা?
জাকির আবু জাফর: কেউ কেউ হঠাৎ দেখে আমার মুখের অবয়বে নজরুলের চেহারার সম্পর্ক নির্ণয় করেন। এটি আনন্দ নিরান্দের কিছু নয়। চেহারার গুরুত্ব তখন পায়  যখন তা কাব্যের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। আমার পৃথিবী হোক কবিতার পৃথিবী এটাই আমার প্রত্যাশা।

নতুন ফেনী : সদা হাসোজ্জ্বল আপনি! মানুষের সাহচর্য কীভাবে উপভোগ করেন?
জাকির আবু জাফর: আমি একজন আশাবাদী মানুষ। আশার আনন্দ জেগে থাকে আমার বুকের ভেতর। সেই সাথে স্বপ্নের পৃথিবীতো আমারই। আমার পৃথিবীর চাঁদ জোছনা রোদ বৃষ্টি আর ছায়ার স্নিগ্ধতা আমি অনুভব করি। অনুভব করি প্রেমাগ্নির শিখা। যে শিখার উষ্ণতায় আমি হাসির উৎসবে মেতে থাকি। মানুষকে ভালোবাসলে হাসা যায়। থাকা যায় হাস্যোজ্জ্বল। জীবনকে হাসির উৎসবে উদযাপন করতে না পারলে কী করে কবিতার সুখ অনুভব করা যাবে। কবিতার সুখ আমার সুখকে সর্বজনীন করে তোলে। সুতরাং মানুষের সহচার্য আমার আনন্দেরই অংশ।

নতুন ফেনী : কিছুদিন টিভি অনুষ্ঠান করলেন, এখন কি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত?
জাকির আবু জাফর: টিভি অনুষ্ঠান এখনো করি। মাঝে মাঝে। বিশেষ দিবস কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানে হাজির হতে হয়। নিয়মিত করছি না। করছি না নানা কারণে। তবে যে চ্যানেল যখন ডাকে উপস্থিত হবার চেষ্টা করি। অন্য কাজে ব্যস্ত মানে ব্যস্ততাইতো জীবন। ব্যস্ত না থাকলে জীবনতো শেষ হয়ে যায়। কাজই আনন্দ। কাজই সুখ। যদি তা মনের সাথে সামঞ্জস্য  থেকে থাকে।

নতুন ফেনী : একজন কবির জীবনে পরিবারের বন্ধুত্বের হাত অনেক দূর যাওয়াÑ আপনার ক্ষেত্রেÑ
জাকির আবু জাফর: পরিবারের বন্ধুত্ব নয় শুধু যাকে বলে ভালোবাসা তার সবটাই আমি পেয়েছি- পাই। কথায় বলে বই আর বউ এক সাথে মেলে না। কিংবা এক হয় না। আমি সেই বিরল ভাগ্যবানদের একজন যার জীবনে বই আর বউ এর সম্মিলন ঘটেছে। সেই সাথে আমার পরিবার এবং শ্বশুরকুলের সকলেই আমার কবিতার আনন্দে আনন্দিত।

নতুন ফেনী : মফস্বলে আপনার বেড়ে ওঠা, আপনার সে সময় আর এই সময় কতটা পরিবর্তন  হয়েছে?
জাকির আবু জাফর: আমি বেড়ে উঠেছি একেবারে পাখির কলগুঞ্জনের ভেতর। নিরন্তর সবুজ দিগন্ত বিশারী ধানের জগৎ এবং বিস্তীর্ণ নীলের খোলা প্রান্তরেরর ভেতর। বেড়ে উঠেছি নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে এবং কুয়শাসিক্ত বিশাল প্রকৃতির ভেতর। একে ঠিক মফস্বলও বলা যায় না একরকম অজপাড়া গাঁ যাকে বলে। যাকে বলে দুর্গম চরাঞ্চল। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। আমি খোলা আকাশ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম উন্মুক্ত মাঠের ভেতর। হেমন্তের অখ- নীল আজো জেগে আছে আমার বুকের গভীরে। হৃদয়ের গহীন উপত্যাকায় আজো ঝরে শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ। আমার সেই গ্রাম সেই ভালোবাসার গাঁ আজ আর নেই বললেই চলে। নদী তাকে গ্রাস করেছে আশ্চর্য দ্রুততায়। আবার প্রযুক্তিগত উন্নতির ঐশ্বর্যে বদলে গেছে সব। সুতরাং সব কিছুতেই বদল। সবকিছুতেই পরিবর্তন। সবকিছুতেই আধুনিকতার স্পর্শ। সেসব দিন আজ কেবলই স্মৃতি।

নতুন ফেনী : ‘আত্মহননের আগে জেনে নাও বন্ধু/প্রেম থেকে বড় কোনো বিরহও নেই। এ দর্শন সত্যি অভিভূত হওয়ার মত। সকলে কি তা মানে?
জাকির আবু জাফর: সকলে যা মানে একজন কবি তা-ই মানবে কেনো? যদি তা-ই হবে তো একজন কবির বিশেষত্ব কোথায়? কবিতো নতুন দর্শন উন্মোচন করবেন। নতুন বোধের উষ্ণতা জাগাবেন জীবনে। জীবন সম্বন্ধে নতুন স্বপ্নের সম্ভাবনা দেখাবেন। সুতরাং সকলে মানে কিনা এটা কোনো কবির বিবেচ্য বিষয় নয়। একজন কবি তার কাজ করে যাবেন নিষ্ঠার সাথে এর চেয়ে বড় কর্তব্য আর কি থাকতে পারে।

নতুন ফেনী : ওরা খাশিয়া যুবতী কবিতায় লিখেছেন- খাশিয়া যুবতী দেখে মনে হয়/পৃথিবীতে এত রূপ আর বুঝি নেই। আবেগের বর্হিপ্রকাশ? এরা বাস্তবে কেমন?
জাকির আবু জাফর: আবেগ ছাড়া জীবনের আনন্দ অথবা প্রেম কোথায়? পাথর আবেগহীন। তাই পাথরের সাথে মাথা ঘঁষা ছাড়া কিইবা করা চলে। যা আনন্দাশ্রিত যা প্রেমাবৃত তাতেতো আবেগের আবহ থাকতেই হবে। প্রেম কি কখনো বাস্তবতার হাত ধরে চলে? প্রেমের অংকে কখনো দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না। হয় পাঁচ না হয় তিন। যখন চার হয়ে যায় প্রেম সেখান থেকে সরে পড়ে। তাছাড়া কবিতাতো কল্পনাকে আশ্রয় করবেই। নইলে সুন্দরীর মুখের কালো তিলের জন্য  সমরখন্দ এবং বোখারার মতো শহর উপহার দেয়া চলে! সুতরাং কবিতার শরীরে যারা বাস্তবতার উৎসংগ খোঁজেন তাদের কবিতার কাছে না যাওয়ায় ভালো।

নতুন ফেনী : দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে জোছনাও আমার ঘরমুখী/ এখন তোমাকে ভিজিয়ে দেবো চাঁদের বৃষ্টিতে’ আপনার অধিকাংশ কবিতাই প্রকৃত প্রেমসত্ত্বার ওপর দাঁড়িয়ে, কেমন লাগে আপনার?
জাকির আবু জাফর: প্রেম নিয়ে যখন কবিতা হবে তখন তো প্রকৃত প্রেমসত্তাই সেখানে দাঁড়াবে। প্রেমে কোনো ভ-ামী চলে না। প্রেম চিরদিনই নিখাঁদ স্বচ্ছ এবং হৃদয়াশ্রিত। সুতরাং হৃদয় যেখানে সেখানে প্রতারণা অথবা শঠতার উপস্থিতি চিন্তাও করা যায় না। যে কারণে, আমি যখন প্রেমানন্দের কথা বলবো তখন আমাকে সত্যিকার প্রেমের কথাই উচ্চারণ করে যেতে হবে। আমি তাই করি। ফলে ভীষণ ভালো লাগে।

নতুন ফেনী : সদ্য প্রকাশিত ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’ সত্যি কবিতা পাঠকদের জন্য আনন্দের। কিন্তু অনেকগুলো কবিতা থেকে ১০০টি বের করাতে কেমন বেগ পেতে হয়েছে?
জাকির আবু জাফর: একজন কবির রচিত সব পঙ্ক্তিমালা সন্তানের মতই। সুতরাং কোন সন্তান অধিক গুরুত্বের এ প্রশ্ন বিব্রতকর। তবু তাকে পার্থক্য নির্ণয় করতে হয়। বলতে হয় কোন সন্তান কোন বৈশিষ্ট্যের। আমার কবিতাও তেমনই একটি প্রেক্ষিতের হাত ধরে  বাছাইপর্বে ১০০তে দাঁড়িয়েছে। বেগ পেতে হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কত  বড় বেগ পেতে হয়েছে সে কথা ব্যাখ্যা করে কী আর হবে?

1655183_255592104618145_189463962_o

নতুন ফেনী : ‘বরষার লাল গোলাপ’ কবিতায় আপনি পুরো পৃথিবীর সময়কে ফ্রেমে বন্দি করেছেন। (খুনের প্রান্তর যেনো ইরাকের প্রাচীন জমিন/ পৃথিবীর সব প্রান্তে এ খুনের নহর বইছে)- এটাই কি কবিতার নিয়তি?
জাকির আবু জাফর: এখানে কবিতার নিয়তির কথা উঠছে কেনো? কবিতার নিয়তি নিয়ে কবিতা কখনো ভাবেনি, ভাববেও না। বরং এ কবিতায় জেগে আছে মানবজাতির নিয়তির কথা। মানুষই মানুষের হন্তারক তার কথা। হিংস্র জানোয়ারের চেয়ে মানুষের জন্য মানুষ আজ বেশি হুমকির। বেশি অনিরাপদ। মানুষকে রক্ষার জন্য যত না আয়োজন তার থেকে হাজার গুণ বেশি আয়োজন মানুষকে ধ্বংসের। এ কবিতায় তারই চিত্র এবং প্রতিবাদ ধ্বনিত।

নতুন ফেনী : আপনি যা বলতে চান, তা কি কবিতায় সবটুকু বলতে পারেন? না সাহিত্যের অন্য শাখায় বলেন?
জাকির আবু জাফর: না তা পারি না। সম্ভবত: কোনো কবির পক্ষেই তা বলা সম্ভব নয়। বরং যা বলতে অথবা লিখতে বসি তার ছিটে ফোটাও হয়তো থাকে না। সম্পূর্ণ নতুন জগৎ এসে আমাকে গ্রাস করে। নতুন শব্দ নতুন বাক্য এমনকি নতুন পৃথিবীর দরোজাগুলো একের পর এক খুলতে থাকে। আমি কোন দরজা দিয়ে  উঁকি দেবো তা ভাববার আগেই ঘটে আরো নতুনের আগমন। আরো অন্যরকম অন্য চেহারার অন্য কথার উপস্থিতি আমাকে আপ্লুত করে। সত্যকথা হলো যে ভাবনা ভর করে কবিতার যাত্রা শুরু হয় শেষাবধি কবিতা যেনো সেখানে থাকেই না। সে উড়াল তোলে অন্য ভাবনার পাখায়।

নতুন ফেনী : কবিতা কাউকে খালি হাতে ফিরায় না, আবার অভিযোগ আছে কবিতা খুবই নিষ্ঠুর- বিষয়টা কিভাবে নেন?
জাকির আবু জাফর: দুটোই সত্য। কবিতা কাউকে খালি ফিরায় না। এর অর্থ হচ্ছে-কবিতা লিখতে গিয়ে কেউ ব্যর্থ হলেও তবু কবি হিসেবে তার নাম থেকে যায়। লোকেরা তাকে কবিই বলে। এটি তার পুরস্কার, কবিতা নিষ্ঠুর এই অর্থে-কবিতা যদি কবিতা না হয়, তাকে পাঠক কখনো গ্রহণ করে না। কবিতা লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করে না। সত্যি কথা-কবিতা কারো প্রতি অনুকম্পা দেখায় না। কবিতা কবিতার জায়গাই অবস্থান করে। কবিকেই আবিষ্কার করতে  হয়- কবিতার পৃথিবী। কবিতা খুবই নিঃষ্ঠুর শুধু এই কথা সত্যি না। কবিতা নির্মমও। একজন কবির সারাটা জীবন খেয়ে ফেলে কবিতা। কবিতা যার জীবন গিলে ফেলে- তার আর মুক্তি নেই। তবে সে সাথে একথাও সত্যি কবিতার মতো নির্ভেজাল বন্ধুও পৃথিবীতে নেই।

নতুন ফেনী : এই সময়ের কবিতায় জীবনবোধ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু ব্যতিক্রম আপনি। নগরের যান্ত্রিকতায় তা কিভাবে করেন?
জাকির আবু জাফর: জীবনবোধই কবিতায় না থাকলো তবে থাকলোটা কি! কবিতাকে জীবনঘনিষ্ঠ হতেই হয়। না হলে কবিতার নিজের জীবন বাঁচে না। কবিতা হয়ে ওঠে না পাঠকের। এই সময়ের কবিতায় জীবনবোধ খানিকটা অনুপস্থিত। কারণ জীবন ও নানা জটিলতায় আক্রান্ত। একইভাবে জীবন দাঁড়িয়েছে ভোগের কাছাকাছি। পুঁজিবাদী সভ্যতার দলনে প্রায় ছিন্নভিন্ন মানুষের আবেগ অনুভূতি। আবেগশূন্য মানুষের পক্ষে জীবনবোধ খোঁজা দুষ্করই বটে। জীবন থেকে দূরে সরে গেলে অথবা প্রেম যখন কেবলই ভোগের বস্তু হয়ে দাঁড়া, যখন সৌন্দর্য বিকিকিনির বিষয় হয়ে যায় তখনো কবিতায় জীবনবোধ অনুপস্থিতই থেকে যায়। জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে জীবনবোধের উপত্যকা চিনিয়েছে। আমি তার অধিবাসী হয়ে থাকতে চাই। নগরের এই যান্ত্রিকতা আমাকে আরো বেশি জীবনের কাছে নিক্ষেপ করেছে। যন্ত্রের গোঙানি আমার কাছে জীবনের গোঙানি বলেই মনে হয়।

নতুন ফেনী : বাংলা সাহিত্যে রম্য, খুবই অবহেলিত। রম্যসাহিত্য নিয়ে ওভাবে কাজ চোখে পড়ে না এখন। তার কারণ কি?
জাকির আবু জাফর: রম্য সাহিত্যে রচনা করা সত্যি কঠিন। যে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করে, সেখানে মানুষের সব কিছু অস্থির থাকে।  কবি লেখকরাও এ অস্থিরতা থেকে মুক্ত নয়। অস্থির চিত্র নিয়ে কখনো রম্যরচনা করা যায় না। যে কারণে, আমাদের এখানে রম্য সাহিত্য সেভাবে বেড়ে ওঠেনি।

নতুন ফেনী : নব্বই দশকে বাংলাদেশের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে তা আপনার সাহিত্যে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
জাকির আবু জাফর: একজন কবি যে দশকে বেড়ে ওঠেন তা তার স্থিতিকালমাত্র। প্রকৃতপক্ষে কবির কোনো নির্দিষ্ট কাল থাকে না। না সময়। না স্থান। কবি চিরকালের কথা বলেন। বলেন জগত থেকে মহাজগতের কথা। নশ্বর থেকে অবিনশ্বরতায় উদ্ভাসিত হন তিনি। কবির নিকট অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বলে কোনো কাল নেই। তার কাল একক অখ- এক মহাকাল। বহমানতার এক চিরন্তণ আনন্দ অথবা বেদনার ভেতর দিয়ে বয়ে যান তিনি। তার কাছে জীবন মানে আশ্চর্য এক মহাজীবনের গান। সুতরাং নব্বই দশক কেনো সব দশক পেরিয়ে সীমাহীনতার ভেতর কবির বসবাস। তবে ঘটনা রটনা অথবা দুর্ঘটনা জীবনকে ছুঁয়ে যায়। যায় বলেই কবিও তাকে কবিতার শরীরে নির্মাণ করে দেন। দেন কিন্তু চিরন্তনতার স্বভাবেই। আমি তাই করি। তাই করেছি। এবং তা-ই করতে হবে।

নতুন ফেনী : লোক প্রশাসনে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে একাডেমিক পড়াশোনা, করেন সাংবাদিকতা, লেখেন কবিতা, কেমন জীবন কাটে?
জাকির আবু জাফর: কবিতার জন্য একাডেমিক লেখা পড়া জরুরি নয় এ-কথাতো সবার জানা। পেশা ও বিবেচনার কোনো বিষয় নয়। যেহেতু কবিতা নেশার ব্যাপার। তবে সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্ট কবিতার বোধকে খানিকটা ত্বরান্বিত করে। উর্বরতা দেয়। আমি এ আনন্দকে উদযাপন করি। আমি জানি জীবন মানেই আনন্দ বেদনার কাব্য। আমি এ দুটোকেই জীবনের সান্নিধ্যে আবিষ্কার করি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে নতুন। প্রতিটি ভোর যেমন সেদিনের জন্য নতুন হয়ে জেগে ওঠে। জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে নিবিড়ভাবে পেয়েছি এর চেয়ে বেশি আর কী চাই।

902863_648708648494520_697019218_oনতুন ফেনী : একজন কবিতার পাঠক হিসেবে ‘জাকির আবু জাফরের কবিতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জাকির আবু জাফর: জাকির আবু জাফরের কবিতার আমি একজন পাঠক। মাঝে মাঝে আমি তার কবিতা পড়ি। পড়ে আনমনা হই। কোনো কোনোটি পড়ে মনে হয় এটি কী তার লেখা! তারপর মনে হয় তাকে এই যাত্রায় যেতে হবে বহু দূর।

নতুন ফেনী : একজন কবি হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বলুন-
জাকির আবু জাফর: বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমৃদ্ধ ভাষা। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার বাক্যকে প্রায় অবিকৃত উচ্চারণের যোগ্য কেবল বাংলা ভাষাতেই রয়েছে। অন্যকোনো ভাষার এতটা সামর্থ নেই। সুতরাং বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ অবশ্যই ভালো। আরো ভালো  একারণে যে বাংলা ভাষায় যে কবিতা রচিত হচ্ছে তা সমসাময়িককালে গোটা পৃথিবীতে উন্নত কবিতার সমতুল্য। এর সমৃদ্ধি এবং উৎকর্ষ আরো বৃদ্ধি পাবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আগেও ছিল, এখনো আছে। আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা মিডিয়ায় মুখ দেখানোর সুযোগ পেলেই ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন। বিষয়টি আমার কাছে খুবই স্থূল মনে হয়। তবু বলছি বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই ভালো। কেননা এ ভাষার শরীরে লেগে আছে রক্তের দাগ।

নতুন ফেনী : বাংলা কবিতা খুবই সমৃদ্ধ হলেও অনুবাদকের অভাবে বর্হিবিশ্বে প্রভাব ফেলছে না, এতে করে কি ধরণের ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করেন?
জাকির আবু জাফর: বাংলা কবিতা, বিশ্ব কবিতার আসরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলা যায়। বিশ্ব কবিতার আসরে বাংলা কবিতার স্থান উল্লেখ করার মতো। কিন্তু বিশ্ববাসী বাংলা কবিতাকে তাদের করে পাচ্ছে না। অনুবাদের ক্ষেত্রে-দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। বাংলা কবিতা তার প্রভাব নিয়ে  বিশ্ব কবিতার আসরে যে প্রবল গতি নিয়ে প্রবেশ করার কথা সেভাবে প্রবেশ করছে না। এর জন্য সে অনুবাদেই দায়ী। এক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা খুব স্বল্প পরিসরে। অথচ প্রয়োজন ছিল সরকারি উদ্যোগের। আমাদের কোন সরকারেই এই বিষয়ে  যথার্থ উদ্যোগ নেয়নি। সরকারি উদ্যোগও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অনুবাদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। এতে বাংলা কবিতা, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছেই থেকে যাচ্ছে। বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে না পারায় ক্ষতি সম্ভবতÑ আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হবে।

নতুন ফেনী : এক সময় গীতি কবিতার বেশ প্রভাব ছিল। কমতে কমতে আজ শূন্যের কোটায়। তার কারণ কি?
জাকির আবু জাফর: না শূন্যের কোটায় পৌঁছাচ্ছে না। গীতি কবিতার প্রভাব সব সময় ছিল। এখনও তার প্রভাব অক্ষত। বাংলা কবিতা আবার-নিরিখেই ফিরে আসবে। বিশ্ব কবিতাও সে কথাই বলছে। কারণ- লিরিক যে কবিতার প্রাণ। একেক সময়ের একেক প্রবাহ থাকে। বাংলার কবিতায় বেশ কিছুকাল ধরে গদ্যের প্রবাহ চলছে। কিন্তু তাই  বলে লিরিক থেকে গিয়েছে এ কথা বলা যাবে না। গীতি কবিতার শক্তি প্রয়োজন। যে কবিতার মধ্যে যে শক্তির যে অভাব রয়েছে । তিনি গীতি কবিতা লিখতে ব্যর্থ হবেন। তবে কবিতা- গদ্য হোক অথবা লিরিকেল হোক কবিতাকে কবিতা হতে হবে এটাই শেষ কথা।

নতুন ফেনী : খুব কাছাকাছি সময়ে বাংলাসাহিত্যের জনপ্রিয় দু’কথার জাদুকর হুমায়ূন-সুনীল চলে গেলেনÑ এ ব্যাপারে   একজন কবি হিসেবে কিছু বলুন-
জাকির আবু জাফর: দু’জনেই আমার প্রিয় লেখক এবং দু’জনেই অত্যন্ত বড় মাপের লোক। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমি গৌরব বোধ করি। তিনি আমার বাংলা ভাষার লোক এবং আমার বাংলাদেশের লোক। তিনি নিজস্বতা রচনা করেছেন। নির্মাণ করেছেন নিজস্ব পৃথিবী। এবং বাংলা গদ্যে নিজস্ব একটি জায়গা সৃর্ষ্টি করেছেন। হুমায়ূন তার মতোই সুনীল গদ্যে-পদ্যে দু’বাহু সমভাবে বিস্তার করেছেন। আমি তার কথাশিল্পের যেমন পাঠক তেমনি কবিতার। তারা দু’জন চলে গেলেন-তাদের চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি।

আপনার মতামত দিন

Android App
Android App
Android App
© Natun Feni. All rights reserved. Design by: GS Tech Ltd.